রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ১২:৪৮ অপরাহ্ন

জেলা-উপজেলায় চিকিৎসা, আস্থার সংকটে ঢাকায় ছুটছে রোগী

জেলা-উপজেলায় চিকিৎসা, আস্থার সংকটে ঢাকায় ছুটছে রোগী

স্বদেশ ডেস্ক:

গত এক দশকে দেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি চোখ পড়ার মতো। ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা-শিক্ষাকেন্দ্র, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চিকিৎসকের চেম্বার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এত সুবিধার পরও রোগীরা চিকিৎসার জন্য রাজধানীতেই ছুটছেন। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, প্রান্তিক চিকিৎসাকেন্দ্রের সেবায় আস্থার সংকট রয়েছে। অনেক সময় রোগীদের অধিকারও নিশ্চিত হয় না। ফলে উন্নত ও বিশেষজ্ঞ সেবা পেতে তারা ঢাকামুখী হচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন দেশের বাইরে।

রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, জেলা-উপজেলার চিকিৎসা অবকাঠামোতে উন্নতির ছোঁয়া লাগলেও বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি থেকে শুরু করে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগের মতো জটিল অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা অপ্রতুল। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় বিভাগ বা ইউনিট, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অ্যানেসথেওলোজিস্ট, অস্ত্রোপচার কক্ষ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাবরেটরি, দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট-টেকনেশিয়ান, নার্স-মিডওয়াইফ ইত্যাদির ঘাটতি রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগে মাকে নিয়ে ভর্তি আছেন বরিশালের রেজা মাহমুদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার মা দীর্ঘদিন কোমর বিডিটিতে ভুগছেন। শারীরিক জটিলতায় ২০০৭ ও ২০১২ সালে অস্ত্রোপচার করাই। বছরখানেক ধরে মা শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন। বরিশালে সরকারি-বেসরকারি একাধিক চিকিৎসক দেখিয়েছি। কেউই রোগ ধরতে পারেননি। বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আমার মায়ের ফুসফুসের একপাশে ৯০ শতাংশ ড্যামেজ হয়ে গেছে। এতবড় জটিল রোগ, অথচ বরিশালের কোনো চিকিৎসক একটি এক্সরে পর্যন্ত করাননি। নিরুপায় হয়ে মাকে এখানে ভর্তি করিয়েছি।

বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, গ্রামের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবায় কিছুটা অনাস্থা থেকেই রোগীরা বিএসএমএমইউতে আসেন। উপজেলা-জেলা ও বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংখ্যাও অপ্রতুল। আরেকটি বিষয় হলো, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় রোগীরা সহজেই ঢাকায় চলে আসছেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের বহির্বিভাগে দৈনিক আট হাজার এবং বৈকালিক সার্ভিসে এক হাজারের মতো রোগী আসেন। দুই হাজার বিছানার ৯০ শতাংশই রোগীতে পূর্ণ থাকে। এর ৭০ ভাগই রেফারেল সিস্টেমে ঢাকার বাইরে থেকে আসা। এজন্য বিশেষায়িত সেবা দিতে ৭৪০ শয্যার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল করা হয়েছে। এই প্রবণতা কমাতে টারশিয়ারি হাসপাতাল (যেখানে সব ধরনের চিকিৎসা হয়) বিকেন্দ্রীকরণ করে সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দক্ষ জনবল নিয়োগ জরুরি।’

টিউমার নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের (ঢামেক) সার্জারি বিভাগে ভর্তি আরেক রোগী বলেন, কয়েক বছর রাজশাহীর একাধিক চিকিৎসকের ওষুধ খেয়েছি। সর্বশেষ একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। সেখানে বড় ডাক্তার ভিজিটে এলেও ভালোভাবে কথা বলতেন না। জুনিয়র চিকিৎসকরা প্রতিদিন পরীক্ষা দিতেন। এত পরীক্ষা কেন করা হচ্ছে, দরকার আছে কিনা- এর কোনো ব্যাখ্যা কেউই দিতেন না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসেছি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, এখানে যেসব রোগী আছেন, তার ৭০ শতাংশেরই অন্য জায়গায় চিকিৎসা খরচ বহনে সামর্থ্য নেই। রোগীরা তিন-চারটি হাসপাতাল ও চিকিৎসক ঘুরে আসেন। আবার কিছু রোগের চিকিৎসা শুধু ঢামেক বা বিএসএমএমউতে সম্ভব, তাই বাধ্য হয়ে আসে। ঢামেক বহির্বিভাগে দৈনিক চার থেকে পাঁচ হাজার রোগী আসেন। দুই হাজার ৬০০ বিছানার বিপরীতে পাঁচ হাজারের মতো ভর্তি থাকেন। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ নতুন রোগী ভর্তি হন।

চিকিৎসা অধিকার আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ছাড়া দেশের অন্য কোথাও উন্নত ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সুবিধা নেই। এ কারণেই রোগীরা ঢাকায় আসেন। তা ছাড়া চিকিৎসক এবং রোগীর যোগাযোগের জায়গায় বড় ঘাটতি রয়েছে। রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। রোগসংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে চাইলে সহজে জবাব দেন না, যথেষ্ট সময় দেন না। হাসপাতালে ভর্তি রোগীরাও চিকিৎসার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য পান না। অপর দিকে চিকিৎসকদের অভিযোগ, অনেক সময় রোগীরা তাদের রোগের সঠিক তথ্য দেন না। ফলে যথাযথ চিকিৎসা তথ্য দেওয়া সম্ভব হয় না। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ব্যক্তিগত চেম্বার সবখানেই রোগীদের এমন অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বের কোথাও এই সমস্যা নাই। মূলত রোগী ও চিকিৎসকের অনুপাতের ফারাক অনেক বেশি হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা দিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মী দরকার। দেশে এমন কর্মী আছেন ১২ জন। অর্থাৎ ৪২ শতাংশ জনবল ঘাটতি নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। ঢাকার বাইরে এই সংকট আরও প্রকট হওয়ায় সঠিক রোগ নির্ণয় ও সুস্থতার ক্ষেত্রে অনাস্থা রয়েছে। ফলে রোগীরা ঢাকায় আসছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, রোগী, চিকিৎসক ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতা, অধিকার এবং একে অপরের সম্পর্কে বোঝাপড়া একেবারেই কম। যারা অধিকার সম্পর্কে জানেন তারা অনুশীলন করেন না। গ্রামে এই চর্চা বেশি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে রোগীরা শহরমুখী হন। তবে, বড় হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা বেশির ভাগই শহর ও নগরের বাসিন্দা। তাদের ৪০ শতাংশ সাধারণ রোগব্যাধি নিয়ে আসেন। গ্রামের রোগীরা জটিল ও মাঝারি রোগ নিয়ে রেফারেল সিস্টেমে আসেন। ঢাকার হাসপাতালের বহির্বিভাগে বেশি ভিড়ের আরেকটি কারণ নগরের প্রাইমারি হেলথ কেয়ার নেই। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কিছু নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও তা অপ্রতুল। এগুলোর প্রতিও রোগীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। এ কারণে নগরে প্রাথমিক সেবা থেকে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি হাসপাতালে রেফারেল পদ্ধতি চালু করতে হবে। নগর ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করলে টারশিয়ারি হাসপাতালে চাপ কমবে। এজন্য সেবাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দক্ষ জনবল নিয়োগ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ এবং রোগীর অধিকারে গুরুত্ব দিতে হবে। বড় হাসপাতালের সম্পদ, অর্থ ও জনবল ব্যয় কমিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877